কথায় আছে- “বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী”- আর লক্ষ্মীলাভের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ বাণিজ্যে রত হয়। আমার দেশে যা উদ্বৃত্ত- আমি তা অন্য দেশকে দেব আর আমার দেশে যেটা কম আছে- আমি অন্য দেশ থেকে নেব এবং আমরা সবাই সেই লাভের গুড় পাবো- এটাই মুক্ত বা অবাধ বাণিজ্যের সরল নিয়ম। কিন্তু এই বাণিজ্য আমার দেশের সব মানুষের যে সমান পৌষমাস আনেনা- তা সহজেই অনুমেয়। এবং এখান থেকেই আসছে আমদানি শুল্কর ভূমিকা। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক- উনিশ শতকের গোড়ায় ব্রিটেনে কৃষকদের চাপে আমদানি করা খাদ্যশস্যের ওপর আমদানি শুল্ক ধার্য করা হয়- যা ইতিহাসে কর্ণ ল নামে পরিচিত। এই শুল্ক শস্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং কৃষকদের উপকারই করেছিল- এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই, কিন্তু খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শিল্পপতিদের মুনাফা কমে যায় যার ফলস্বরূপ তাদের আয় ও বিনিয়োগ কমে যায় ফলে বেকার সমস্যা বেড়ে যায়- অবশেষে ব্রিটিশ সরকার কর্ণ ল প্রত্যাহার করে।
এ তো গেলো উনিশ শতকের কথা। কিন্তু বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের যুগ; আর তাই পৃথিবীর প্রত্যেক্ দেশ তাদের আমদানি শুল্ক কিম্বা রপ্তানি ভর্তুকি কমিয়ে মুক্ত অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ভারত, চিন এরম বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ আশি-নব্বইর দশকে তাদের বাজার বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করেছে, তাতে বেশ কিছু ক্ষেত্র যেমন আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছে, অনেক ক্ষেত্র আবার ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) সদস্য হিসেবে তারা Most Favored Nation (MFN) নীতি মানতে বাধ্য। যে নীতি অনুসারে, প্রত্যেক সদস্য দেশ তার বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর ওপর বৈষম্যমূলক কোনও নীতি প্রয়োগ করবেনা। আবার Preferential Trade Agreement এ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাণিজ্যে উৎসাহিত করার জন্য উন্নত দেশগুলো বাণিজ্য বাঁধা হ্রাস করতে পারবে- এমন নিদানও আছে। যদিও সব দেশই নিজেদের লাভের জন্য কিছু পরিমাণ আমদানি শুল্ক তাদের বাণিজ্যে আরোপ করে। এই প্রসঙ্গে দুই অর্থনীতিবিদ রাউল প্রেবিশ এবং হ্যান্স সিঙ্গার মনে করতেন- উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো যেহেতু কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করে এবং শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি করে তাই তাদের বাণিজ্যহার (রপ্তানি মূল্য এবং আমদানি মূল্যের অনুপাত) সবসময় তাদের প্রতিকূলে থাকে। সেই কারণে উন্নয়নশীল দেশ আমদানিজাত দ্রব্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে যা আমদানির চাহিদা কমিয়ে বাণিজ্যহারকে তাদের অনুকুলে নিয়ে আসে। আর তাই উন্নয়নশীল দেশের আমদানি শুল্ক কিছু পরিমাণ আরোপ করা উচিত। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ রবার্ট মানডেল ১৯৫৭ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেখানে তিনি দেখিয়েছেন- অবাধ বাণিজ্যের যত বেশি প্রতিবন্ধকতা থাকবে, উৎপাদনের উপকরনের (যেমন, শ্রমিক কিম্বা মূলধন) গতিশীলতা তত বাড়বে। যদিও এই বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উপকরণের চলনশীলতা কতটা বাড়িয়েছে তা বিচার্য বিষয় এবং এটা আমাদের আলোচ্য বিষয়ও নয়। তাই এই বিষয় আলোচনা না করে সরাসরি আমাদের আলোচ্য বিষয়ে যাওয়াই বোধ করি সমীচীন হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নানান কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে- তাদের ডলার সারা বিশ্বে রাজ করে বেড়ায়। এককথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের দাদা- যাদের দরকষাকষির ক্ষমতা (Bargaining power) সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের সমীকরণ অনেকটা আলাদা যেখানে আমেরিকাকে ছাপিয়ে চিনের দাদা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্রমশ বর্ধমান- আর যেটাই তাদের সবথেকে বড় চিন্তার কারণ। তবে এখানেই শেষ নয়; আরও কারণ আছে- যেমন, ভারতের রুপি এখন বেশ কিছু দেশ, যেমন- নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ইত্যাদি তাদের বাণিজ্যে গ্রহণযোগ্য মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করেছে আবার ভারত, চিনের সস্তা শ্রমিকের সহজলভ্যতার কারণে আমেরিকার কিছু সংস্থা (যেমন অ্যাপল) এইসব দেশে বিনিয়োগ করেছে যা তাদের উৎপাদনের খরচ-খরচা অনেকটা কমিয়েছে। শুধু তাই নয়, চিনের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে বেশ কিছু বিরল খনিজ, যা ভবিষ্যতে চিনকে অর্থনৈতিকভাবে আরও মজবুত করতে পারে- যেটা আমেরিকার মাথা ব্যাথার আরেকটি বড় কারণ। এর সাথে রয়েছে মেক্সিকো, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ থেকে আমেরিকাতে অভিবাসন। এইসব সমস্যা দূরীকরণের শপথ নিয়ে আমেরিকার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভের লক্ষ্যে ২০২৪ সালে রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। আর প্রথম তিনি যে দুটো কাজ করলেন- তার মধ্যে একটি হল অভিবাসন নীতির সংস্কার আরেকটি হল পূর্বতন যে শুল্ক যুদ্ধ তিনি শুরু করেছিলেন সেটা আবার নতুন উদ্যমে শুরু করা। আজকের এই প্রতিবেদনে আমি প্রথম নীতি নিয়ে কোনোরকম আলোচনা করছিনা বরং সারা পৃথিবীর ওপর ব্যপক প্রভাব বিস্তার করা সেই শুল্ক যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।
ট্রাম্প কি তার এই শুল্ক নীতির মাধ্যমে সারা বিশ্বে একেবারে মুক্ত বাণিজ্য নীতি শুরু করার মন্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলেন? আশা করি সবাই ভাবছেন এইতো বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুল্ক যুদ্ধ করে সারা বিশ্বে মুক্ত বাণিজ্যের সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছেন; তিনি আবার মুক্ত বাণিজ্য নীতি প্রবর্তন করতে যাবেন কোন দুঃখে? হতে পারে যে ট্রাম্প “বিষে বিষে বিষক্ষয়” নীতি অবলম্বন করছেন। মুক্ত বা অবাধ বাণিজ্যের কাছে যেকোনো প্রকার বাঁধা (যেমন- আমদানি শুল্ক বা রপ্তানি ভর্তুকি) হল বিষতুল্য আর এই বিষতুল্য আমদানি শুল্ক অন্য দেশের ওপর আরোপ করে সেই দেশকে একেবারে বিষক্ষয় করা অর্থাৎ মুক্ত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করা- এটা কি মার্কিন প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য? দুনিয়া যে এত সহজ পন্থাতে চলেনা- তিনি সেটা বিলক্ষণ বোঝেন। ট্রাম্প বলল আর সারা বিশ্ব মুক্ত বাণিজ্য প্রতিস্থাপনের যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লো- এটা সম্ভব নয়। আর এখান থেকেই আসছে পারস্পরিক শুল্কর (Reciprocal tariff) ভূমিকা। অর্থাৎ আপনি যদি আমার দেশের ওপর অন্যায্যভাবে শুল্ক বসিয়ে আমার দেশের ক্ষতি করেন, আমিও আপনার দেশের ওপর সমান শুল্ক বসাব। তাই প্রেসিডেন্টের উদ্দ্যেশ্য যে মুক্ত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা না; বরং তার থেকে খানিক বড়- তা সহজেই অনুমেয়।
আগেই বলেছি, বর্তমানে বিভিন্ন কারণে আমেরিকার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে কমছে আর তাই সেই প্রভাব অটুট রাখতে, সারা বিশ্বে আমেরিকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আরও প্রসারিত করতে এটা ট্রাম্পের একটা সুনিপুণ কৌশল, যেখানে তিনি ধমকে চমকে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাধ্য করছেন তাদের আমদানি শুল্ক কমাতে এবং আমেরিকায় উৎপাদিত দ্রব্য বিনা বাঁধায় তাদের দেশে ছড়িয়ে দিতে। এতে যেমন একাধারে আমেরিকা লাভবান হবে আবার অন্য দেশগুলোকে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে এই সমস্ত উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের বাজার দখল করতে পারবে। লেনিন যাকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রথম ধাপ বলেছেন, যেটিকে তিনি দ্রব্যের রপ্তানি বলছেন। দ্বিতীয় ধাপে আমেরিকা ধীরে ধীরে এই সব দেশে বিনিয়োগ করে দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবে- যেটাকে লেনিন মুল্ধনের রপ্তানি বলে অভিহিত করেছেন। যদিও এই পর্যায় এখনও সেইভাবে আসেনি তবে ভবিষ্যতে আসার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এইভাবে আবারও ট্রাম্প তার দেশের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। আমরা ইতিমধ্যেই সংবাদপত্র মারফত এটা আন্দাজ করতে পেরেছি যে ট্রাম্প একজন পুরদস্তুর শিল্পপতি আর তাই তার কাছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও শ্রমিক শোষণ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পন্থা। এটাই তিনি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে একটা কর্পোরেট প্রকৃতির সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন- যেটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শেষ পর্যায়। আপনারা একটু খেয়াল করলে দেখবেন ট্রাম্প উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি হারে আমদানি শুল্ক বসিয়েছেন- যা MFN নীতির পরিপন্থী- কিন্তু কেন ট্রাম্প এরম কাজ করলেন? এখানেও ট্রাম্পের সেই পুঁজিবাদী মনোবৃত্তির প্রতিফলন পাওয়া যায়। আপনাদের আগেই বলেছি, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করে- যার দাম মুলত খুব একটা বেশি হয়না; কিন্তু তারা বেশিরভাগ গরিব হওয়ার কারণে আমেরিকার দামী দ্রব্য আমদানি করতে পারেনা। ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল বলছে- যেহেতু তারা দামী দ্রব্য আমদানি করতে পারেনা সেই কারণবশত তারা রপ্তানি করে বেশি ডলার উপার্জন করে এবং চলতি খাতে (মোট রপ্তানি থেকে মোট আমদানির বিয়োগফল) তাদের উদ্বৃত্ত হয়- যেটা ট্রাম্পের রাগের মূলকারণ। তাই তাদের লাভের সবটুকু কেড়ে নিতে ট্রাম্পের এই নীতি। আবার তিনি শুল্ক কমানোর বদলে আমেরিকায় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন, গরিব দেশগুলির পক্ষে এই বিনিয়োগ সম্ভব নয়, তাই তারা একপ্রকার শুল্কের জাঁতাকলে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
তবে পারস্পরিক শুল্কের নিয়মে শুধু আমেরিকা নয় সারা বিশ্বে প্রত্যেকটি দেশ যাদের ওপর ট্রাম্প এরম অন্যায্য আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন- তারা কেওই বসে থাকবেনা বরং প্রত্যেকেই পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর- যা এক কথায় সারা বিশ্বে একটা মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করবে এবং পরিণাম- বিশ্বব্যাপী সমস্ত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি, যার ফলস্বরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারন মানুষ। সেই বিখ্যাত প্রবাদটির কথা মনে পড়ছে- ‘’ রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।‘’ মুদ্রাস্ফীতির ফলস্বরূপ প্রত্যেকটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াবে, যা আসলে বিনিয়োগ হ্রাসেরই নামান্তর- ফল কি? বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা- যা ঘটেছিল ১৯২৯ সালে, ২০১০ সালে বা ২০২০ সালে করোনা অতিমারিতে। যার থেকে মুক্তি পাবেনা ট্রাম্পের দেশ আমেরিকাও। এইভাবে ট্রাম্প “Make America Great Again” কে “The Great Depression” এ পাঠানোর বন্দোবস্ত করছেন। মনে রাখা দরকার, ১৯৩০ সালেও স্মুট-হাওলে শুল্ক আমেরিকা আরোপ করেছিল প্রায় ২০,০০০ আমদানিকৃত দ্রব্যের ওপর- যেটি ১৯২৯ র মন্দা কিন্তু আরও ত্বরান্বিত করেছিল।
যদিও এটা সত্যি যে আমেরিকার সরকার এই আমদানি শুল্কের মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা অর্জন করছে যা রাজকোষ ঘাটতি পূরণে অনেকটা সাহায্য করবে কিন্তু একটা সময় পর যদি সব দেশ আমেরিকাকে একঘরে করে দেয়, তখন কি হবে? ভারতসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে মূলত আমেরিকা আমদানি করে বস্ত্র, দামী পাথর, রত্ন, গাড়ীর যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। এবারে আমেরিকাতে এই সমস্ত দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে এমনিই চাহিদা কমে যাবে যা আদতে সরকারের শুল্ক থেকে প্রাপ্ত আয় কমিয়ে দেবে। সুতরাং ট্রাম্প এই শুল্ক যুদ্ধর মাধ্যমে নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছেন। এই মুহূর্তে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিশেষত চিন, ভারত এবং রাশিয়া এই ত্রয়ি শক্তির উত্থান, ব্রিকস মুদ্রা প্রচলনের প্রস্তাব, শুল্ক আরপের পরও আমেরিকার ক্রমাগত সরকারি ঋণ বৃদ্ধি সেই আভাসই বহন করছে। এবারে ট্রাম্প শিক্ষা নিয়ে শুল্ক যুদ্ধ বন্ধ করবেন, নাকি চালিয়ে যাবেন সেটাই দেখার বিষয়।