About Us | Contact Us |

The Bicycle Thief: চুরি হওয়া মানুষের মর্যাদা

লিখেছেন : নিচিতা ঝা
The Bicycle Thief: চুরি হওয়া মানুষের মর্যাদা

রোম, ১৯৪৮। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক শহর, যেখানে মানুষের মুখে ক্লান্তি, ভিড়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দারিদ্র্যের ছাপ। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আন্তোনিও, এক সাধারণ শ্রমিক, যার জীবন যেন ভরসাহীন। একদিন হঠাৎ করে তিনি চাকরির সুযোগ পান পোস্টার সাঁটানোর কাজ। চাকরিটা তুচ্ছ মনে হলেও তাঁর কাছে এটি জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। কারণ, এটাই তাঁর পরিবারকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায়। কিন্তু চাকরির শর্ত, একটা সাইকেল থাকতে হবে।

স্ত্রী মারিয়া তাঁদের একমাত্র বিছানার চাদর বন্ধক রেখে সেই সাইকেল জোগাড় করে দেন। সেই দৃশ্যটা ভীষণ বেদনাদায়ক কারণ, আমরা বুঝতে পারি, দারিদ্র্যের কাছে কতটা অসহায় মানুষ। এক টুকরো চাদরের বিনিময়ে তাঁরা কিনে আনলেন আশা, মর্যাদা আর বেঁচে থাকার লড়াই। কিন্তু নিয়তির নির্মম খেলা, প্রথম দিনেই সেই সাইকেল চুরি হয়ে গেল। মুহূর্তেই পরিবারের ভরসা ভেঙে পড়ল, আর শুরু হল এক মরিয়া অনুসন্ধান।

এরপরের সিনেমা এক দীর্ঘ ভ্রমণ রোমের পথে পথে, বাজারে, ফুটপাতে, চার্চে, বৃষ্টিভেজা রাস্তায়। আন্তোনিও ছুটছেন, ছেলের হাত ধরে মরিয়া হয়ে খুঁজছেন তাঁর সাইকেল। প্রতিটি দৃশ্য এতটাই জীবন্ত যে মনে হয় আমরা নিজেই তাঁদের সঙ্গে হাঁটছি। এক জায়গায় ব্রুনো বাবার জন্য ছাতা ধরে রাখছে, অন্য জায়গায় হোঁচট খেয়ে পড়ছে আর বাবার হাত আঁকড়ে আবার দাঁড়াচ্ছে। এই মুহূর্তগুলো আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বাবা–ছেলের সেই অদ্ভুত সম্পর্ক, যেখানে ভালোবাসা আছে, ভরসা আছে, কিন্তু সাথে আছে অভাবের নির্মম ছায়া।

সিনেমার প্রতীকী শক্তি এখানেই সাইকেলটা আসলে কেবল একটা বাহন নয়। এটি জীবনচক্রের প্রতীক। এটি টিকে থাকার, বাঁচার, স্বপ্ন দেখার প্রতীক। সাইকেল হারানো মানে সেই জীবনচক্র থেমে যাওয়া, মানে স্বপ্ন ভেঙে পড়া, মানে আত্মসম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া। আর ব্রুনোর ছোট্ট হাত, এটাই পুরো সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক। কারণ, সেই হাতই হলো আশা, যা বাবাকে বারবার টেনে নিয়ে আসে হতাশা থেকে।

কিন্তু সিনেমার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক মুহূর্ত আসে শেষের দিকে। সারা শহর খুঁজেও সাইকেল না পেয়ে আন্তোনিও মরিয়া হয়ে নিজেই অন্যের সাইকেল চুরি করার চেষ্টা করেন। সেই দৃশ্যটা ভীষণ বেদনাদায়ক। কারণ, আমরা বুঝতে পারি, দারিদ্র্য মানুষকে কেবল শারীরিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও ভেঙে দেয়। আর সেই মুহূর্তে ব্রুনোর চোখে যে হতাশা, যে ব্যথা ধরা পড়ে তা কেবল সিনেমার নয়, সমগ্র মানবজীবনের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। শেষ দৃশ্যে যখন আন্তোনিও লজ্জিত মুখে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর ব্রুনো তাঁর হাত আঁকড়ে ধরে, তখন দর্শকের বুক ফেটে কান্না আসে। এটি কেবল এক বাবার পরাজয় নয়, এটি এক গোটা সমাজের পরাজয়।

ভিট্টোরিও দে সিকা এই সিনেমাকে বানিয়েছেন একেবারেই বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। এখানে নেই বড় বাজেট, নেই চমকপ্রদ সেট, নেই নামী অভিনেতা। নন-প্রফেশনাল অভিনেতাদের ব্যবহারেই ছবির প্রাণ। আন্তোনিওর মুখে হতাশা, স্ত্রীর চোখে যন্ত্রণা, আর ব্রুনোর নিষ্পাপ দৃষ্টিতে বিস্ময়, এসব কোনো অভিনয় নয়, যেন বাস্তবের টুকরো। ফলে দর্শক সিনেমা দেখতে বসে ভুলে যায় যে সে সিনেমা দেখছে, বরং মনে হয় রোম শহরের রাস্তায় সত্যিই এক বাবা–ছেলের সঙ্গে হাঁটছে।

কিন্তু The Bicycle Thief শুধু এক ব্যক্তির কাহিনি নয়। এটি যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। সেই সময়ের বেকারত্ব, অভাব, অস্থিরতা, মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, সবই এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। এই গল্প কেবল আন্তোনিওর নয়, বরং হাজারো শ্রমজীবী মানুষের কাহিনি, যারা প্রতিদিনই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে।

সবচেয়ে বড় সত্য হলো, এই সিনেমা কেবল ইতিহাসের দলিল নয়, আজও সমান প্রাসঙ্গিক। আমাদের সমাজেও প্রতিদিন হাজারো মানুষ তাদের স্বপ্ন হারাচ্ছে, অভাবের কাছে মাথা নত করছে। আমরা তাদের দেখি, কিন্তু দেখতে চাই না। আমরা তাদের কান্না শুনি না। অথচ The Bicycle Thief আমাদের চোখ খুলে দেয়, মনে করিয়ে দেয়, দারিদ্র্য কোনো দূরের ঘটনা নয়, এটি আমাদের আশেপাশেই প্রতিদিন ঘটছে।

শেষ পর্যন্ত এই সিনেমা আমাদের শেখায়, জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি কখনো বাহ্যিক নয়, বরং আত্মসম্মান ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা। একটি সাইকেল হারানো মানে কেবল একটি বাহন হারানো নয়, বরং একটি পরিবার, একটি সম্পর্ক, একটি জীবনের ভিত্তি ভেঙে পড়া। আর তাই The Bicycle Thief কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি মানবতার এক অমূল্য দলিল। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সবচেয়ে বেশি অন্ধকার সেই সমাজেই থাকে, যে সমাজ দারিদ্র্যকে দেখতে চায় না, আর প্রান্তিক মানুষের কান্না শুনতে অস্বীকার করে।

নিচিতা ঝা
নিচিতা ঝা

স্নাতক অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

গল্প হলেও সত্যি

04 July, 2025 | : মীর রাকেশ রৌশান

স্মৃতির শহর মুর্শিদাবাদ

04 July, 2025 | : ফারুক আব্দুল্লাহ