যখন সোনম ওয়াংচুক যিনি একজন প্রকৌশলী, যিনি গলতে থাকা হিমনদকে “বরফ স্তূপ” বা আইস স্টুপার আকারে রূপান্তরিত করেছিলেন এবং টেকসই হিমালয় জীবনধারার ভিশন দিয়ে নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনিই গ্রেফতার হন লাদাখেই,লাদাখের অঞ্চলের দাবি সরকারের কাছে রাখার জন্য!। তখনই পুরো লাদাখ কাঁপে! কিন্তু এই কাঁপেনি ভূমিকম্পের নয়, এটা বরং একটা সরকারী দমনমূলক পদক্ষেপের ঢেউতে, যা শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণ আর গান্ধীধর্মী আন্দোলন হিসেবে! ওয়াংচুক শুধুমাত্র একজন উদ্ভাবক নন; তিনি লাদাখের নৈতিক দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছেন, জনগণের ন্যায়, প্রতিনিধিত্ব ও পরিবেশ রক্ষার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তার গ্রেফতার শুধু এই অঞ্চলের মধ্যে নয়, দেশের বাইরেও প্রভাব ফেলেছে, যা ভারতীয় সীমান্তাঞ্চলের নাগরিক প্রতিবাদের এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার মধ্যে বিদ্যমান টানাপোড়েনকে উদঘাটন করেছে।
ওয়াংচুকের গ্রেফতারের দিকে নিয়ে যাওয়া প্রতিবাদগুলি হঠাৎ ফেটে পড়া ছিল না; এগুলি ছিল বছরের পর বছর ধরে বৃদ্ধি পাওয়া হতাশার পরিণতি। ২০১৯ সালে যখন লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা করে বিধানসভা বিহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়, তখন অনেক লাদাখি তাদের জমি, চাকরি এবং স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন বলে অনুভব করেছিলেন। ৯০% এরও বেশি মানুষ স্বল্পসংখ্যক জাতি (Scheduled Tribes) এর অন্তর্ভুক্ত এবং তারা দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ সাংবিধানিক সুরক্ষা বিশেষত ষষ্ঠ সূচি (Sixth Schedule) অনুসারে চেয়ে আসছিল, যাতে তারা জমি, বন ও সাংস্কৃতিক চর্চায় স্বায়ত্তশাসন পায়। সাংবিধানিক সুরক্ষার পাশাপাশি লাদাখের মানুষদের দাবি রয়েছে একটি আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, চাকরিতে রিজার্ভেশন বৃদ্ধি, সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের সম্প্রসারণ এবং পর্যটন, অবকাঠামো প্রকল্প ও শিল্প উন্নয়নের unchecked প্রভাব সীমিত করার জন্য কঠোর পরিবেশ সুরক্ষা। এই দাবিগুলি কেবল রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নয়; এগুলি হলো জমি ও সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রতি বাস্তবিক চ্যালেঞ্জ।
সেপ্টেম্বর মাসে, ওয়াংচুক ১৪ দিনের অনশন শুরু করেন এই দাবিগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। যা শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হিসেবে, তা দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, বিশেষত যখন দুজন বয়স্ক অনশনকারী হাসপাতালে ভর্তি হন। হাজার হাজার লাদাখি লেহে সমবেত হন, রাজ্যসভা এবং সাংবিধানিক সুরক্ষার জন্য স্লোগান দেন। শান্তিপূর্ণ সূচনা সত্ত্বেও, কিছু প্রতিবাদকারীরা যানবাহন ও ভবন জ্বালিয়ে দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ এবং পরে গুলি চালায়। অন্তত চারজন প্রাণ হারান এবং বহু মানুষ আহত হন, যা সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখের অন্যতম রক্তক্ষয়ী দিন হিসেবে ধরা হয়।
প্রতিক্রিয়ায়, কর্তৃপক্ষ কারফিউ জারি করেন, ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করেন এবং ওয়াংচুকের এনজিও SECMOL এর FCRA লাইসেন্স বাতিল করেন, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে। আইনীভাবে, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (BNSS) ২০২৩-এর ধারা ১৬৩ অনুযায়ী প্রতিবাদ, সমাবেশ এবং জনসমক্ষে ঘোষণা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওয়াংচুককে গ্রেফতার করা হয় “উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য” দেওয়ার অভিযোগে, যা হিংসা উদ্রেক করেছে বলে সরকার দাবি করে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে এই পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য, অনেক লাদাখি এটি তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক কণ্ঠনীরব করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন।
ওয়াংচুকের গ্রেফতার কেবল একজন ব্যক্তির ব্যাপার নয়। তিনি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতীক, সেই ব্যক্তিত্ব যার চারপাশে লাদাখিরা তাদের সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য একত্রিত হয়। তাকে আটক করে, কর্তৃপক্ষ জনসমাজকে আরও একত্রিত করার ঝুঁকি নিচ্ছে, শান্তিপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে রূপান্তরিত করতে ক্রোধ ও প্রতিবাদে। দেশজুড়ে, এই গ্রেফতার ভারতের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার পরীক্ষার মুহূর্তে দেশ কি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সহ্য করতে পারবে? নাকি preventive detention এবং জোরপূর্বক পদক্ষেপই সংলাপের জায়গা দখল করবে। লাদাখের যুবকদের জন্য বার্তা স্পষ্ট: শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও কারফিউ, ইন্টারনেট ব্লক এবং কারাবাসের কারণ হতে পারে।
একই সময়ে, সরকার একটি কঠিন সমীকরণের মুখোমুখি। আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা অপরিহার্য, বিশেষত হিংসা ও হতাহতের পর, কিন্তু শুধুমাত্র জোরপূর্বক পদক্ষেপ দিয়ে লাদাখের সাংবিধানিক ও উন্নয়নমূলক দাবি দূর করা সম্ভব নয়। পরিবেশগত সংবেদনশীলতা, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিগুলি গ্রেফতার বা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দূর হবে না। অর্থবহ সংলাপ এবং কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া, অশান্তি আরও তীব্র আকারে ফিরে আসতে পারে।
সোনম ওয়াংচুকের গ্রেফতার আর কেবল আইনগত ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্র ক্ষমতা ও নাগরিক কণ্ঠের, উন্নয়ন ও টেকসইতার, ক্ষমতা ও নৈতিকতার নাজুক ভারসাম্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস বিচার করবে এই মুহূর্তটি লাদাখের জন্য এক সমঝোতার দিন হবে, যেখানে সংলাপকে দমনপন্থার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, নাকি একদিনের জন্য পাহাড়ের আহ্বান অবহেলিত থেকে যায়। একটি বিষয় নিশ্চিত: হিমালয় এবং যারা তাদের পর্যবেক্ষণ করছে, তারা সবাই শুনছে।